নিজস্ব প্রতিবেদক। নরসিংদী প্রতিদিন-
সোমবার ২১ অক্টোবর ২০১৯:
তিনি চাকরিতে নেই কয়েক বছর। তাতে কী? অবসরে গিয়েও ভিআইপি প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করেন। ঢাকার উত্তরার বাসা থেকে বের হলে সামনে ইউএনও আর পেছনে থাকে ওসির গাড়ি। সাইরেন বাজিয়ে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার হাতিরদিয়া গ্রামের বাড়িতে যান।
আলিশান সেই বাড়িতে পৌঁছলে আগে থেকে অপেক্ষারত থানা পুলিশের আরেকটি দল দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। খুলে দেয় ফটকও। এরপর তিনি ঢোকেন নিজ বাড়িতে। যে কয়েক দিন গ্রামের বাড়িতে থাকেন সেখানে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকে পুলিশের একটি দল। ইউএনও আর ওসির সাময়িক ছুটি মিললেও সময়ে সময়ে এসে ওই বাড়িতে বসে থাকতে হয়। এর মধ্যে নানা তদবির আর নির্দেশ তো আছেই। এভাবেই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দীর্ঘ সময় পরও সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানকে প্রটোকল দিতে হয় নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলা প্রশাসনকে।
তবে বিসিএস (প্রশাসন) ৮১ ব্যাচের সাবেক এই কর্মকর্তা বেশি আলোচনায় আসেন নিজের ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ নিয়ে। প্রভাব বিস্তার করে তিনি ওই সনদ পুনরায় বহালের চেষ্টা চালালেও নতুন করে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
তবে শুধু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদই নয়, দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরও চমকপ্রদ কিছু তথ্য। এর মধ্যে রয়েছে স্কুলের নামে লাখ লাখ টাকার প্রকল্পের অনুমোদন নিয়ে নিজের বাড়ি উন্নয়ন, আপন চাচিকে মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে জমি দখল করে ব্যক্তিগত রাস্তা নির্মাণ, তথ্য গোপন করে রাজউক থেকে উত্তরা ও পূর্বাচলে দুটি প্লট গ্রহণ এবং রাজধানীর উত্তরায় বাড়ি নির্মাণে অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটানোসহ স্থানীয় রাজনীতিতে নিজের ক্ষমতার দাপট দেখানো। এ ছাড়া সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও খাদ্য অধিদপ্তরের সরকারি গাড়িচালক দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। পরে অবশ্য খাদ্য অধিদপ্তর সেই চালককে প্রত্যাহার করে নেয়।
‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ’ নিয়ে তুলকালাম : নরসিংদীর মনোহরদীতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার অভিযোগে সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানসহ ১০ জনকে তলব করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। আগামী ২৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার অভিযোগ যাচাইবাছাই করার জন্য সাক্ষী ও দালিলিক প্রমাণাদিসহ কাউন্সিলের সম্মেলন কক্ষে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের। গত মাসের ১৭ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলের সহকারী পরিচালক কাজী মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন স্বাক্ষরিত আলাদা দুটি পত্রের মাধ্যমে তাদের তলব করা হয়।
এদিকে জামুকায় অভিযোগ করায় অভিযোগকারী কাজী শরিফুল ইসলাম শাকিলকে পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের দিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের বিরুদ্ধে। এর আগে ২০১৪ সালে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানসহ কয়েকজন শীর্ষ সচিব ‘অবৈধ প্রক্রিয়ায়’ মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এলে তা বাতিলের সুপারিশ করে দুদক। ওই সুপারিশের পর একই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর জামুকার বৈঠকে সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের সনদ ও গেজেট বাতিল করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
জামুকায় দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়, মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান মনোহরদী উপজেলার সৈয়দেরগাঁও গ্রামের প্রয়াত ডা. দানিশ মোল্লার ছেলে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে যাননি এবং বাংলাদেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ করেননি। কিন্তু ২০১৭ সালে মনোহরদী উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং যাচাইবাছাই কমিটির সদস্য সচিব কোনো তদন্ত ছাড়াই ওয়াহেদুজ্জামানের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।
ওই অভিযোগে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যরা বাজারের ইজারা থেকে শুরু করে নিরীহ মানুষের জমি দখল, চাঁদাবাজি, চাকরি, তদবির বাণিজ্য ও নিরীহ মানুষকে হয়রানিসহ সব ধরনের অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। এসব কাজে তারা অবৈধভাবে প্রশাসনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার কথামতো কাজ না করলে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্তাদের শাস্তিমূলক বদলি করে দেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ছোট শুকুন্দী গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে ভারতে ট্রেনিং নিতে হবে, বাংলাদেশে যেকোনো কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করতে হয়। তিনজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার নাম বলতে হয়। মনোহরদীতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা কোনো কমান্ডারের সঙ্গে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধ করেনি। তাই তিনি নিজেকে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন?’
আইন ভঙ্গ করে উত্তরা ও পূর্বাচলে প্লট : রাজউকের উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের ৪ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর রাস্তার ৪২ নম্বর প্লটটি মোল্লা ওয়াহেদুজ্জানের। পাঁচ কাঠা আয়তনের এই প্লটে তিনি গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি। এ ছাড়া রাজউকের পূর্বাচল উপ-শহর প্রকল্পে সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান বরাদ্দ নিয়েছেন বল জানিয়েছেন সংস্থাটির পরিচালক আহসান ইকবাল ভূঁইয়া। তবে পূর্বাচলে নিজ নামে কোনো প্লট বরাদ্দ নেননি বলে দাবি করেছেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান।
রাজউকের কর্মকর্তারা জানান, বরাদ্দের নিয়মাবলি অনুযায়ী যেকোনো প্লট বরাদ্দের সময় একটি হলফনামা জমা দিতে হয়। সেখানে উল্লেখ করতে হয় যে, আবেদনকারীর নিজ নামে এবং স্ত্রী, সন্তান বা পোষ্য কারও নামে রাজউক থেকে নেওয়া কোনো প্লট নেই। যারা তথ্য গোপন করে একাধিক প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন তাদের একটি প্লট রেখে আরেকটি বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
উত্তরায় আলিশান বাড়ি, নির্মাণে নকশার ব্যত্যয় : উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের প্লটে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের আলিশান বাড়িটি নির্মাণেও হয়েছে অনিয়ম। বাড়ির ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ এবং সেটব্যাক ও ফার নিয়ম না মেনে করা হয়েছে বলে রাজউকের পরিদর্শক টিম দেখতে পেয়েছে। কিন্তু ওয়াহেদুজ্জামান প্রভাবশালী হওয়ায় রাজউক সেখানে কোনো অভিযানে যায়নি।
স্কুলের নামে প্রকল্প নিয়ে নিজের বসতবাড়ির উন্নয়ন : মনোহরদীর উদয়ন স্কুলের নামে প্রকল্প নিয়ে সেই অর্থ দিয়ে হাতিরদিয়া গ্রামে নিজের বাড়ির বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান। এ কাজটি তিনি মনোহরদী উপজলোর সাবেক ইউএনও মো. শহীদউল্লাহকে ম্যানেজ করে করিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, তিনি বাসায় এসি লাগানোসহ নানা কাজে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজে লাগান। গত ছয়-সাত বছর ধরে চলা এ বিষয়টি জেলা প্রশাসনও অবগত আছে।
চাচির জমিতে ব্যক্তিগত রাস্তা নির্মাণ : নিজের তৈরি করা আলিশান বাড়িতে যানবাহন প্রবেশ করানোর মতো কোনো রাস্তা রাখেননি। বাড়ি নির্মাণের পর রাস্তার জমি দেওয়ার জন্য চাপ দেন চাচিকে। কিন্তু চাচি রাজি না হওয়ায় এক পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনকে দিয়ে চাপ দিয়ে চাচির জমির ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করিয়ে নেন তিনি।
প্রটোকল না দিলে টিকতে পারেন না ইউএনও-ওসি : শুধু সাধারণ মানুষ নয়, মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের অবৈধ ও অনৈতিক নির্দেশ না মানায় খড়গ উঠেছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপরও। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হয়েও তিনি এখনো প্রটোকল নিয়ে চলাফেরা করেন। বাড়িতে অবস্থান করার সময় বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয় পুলিশি প্রহরা। উপজেলার সব প্রশাসনিক কর্মকর্তা তার তাঁবেদারি না করলে মনোহরদীতে থাকা দুরূহ। মনোহরদীর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেগম নাসরিন সুলতানাকে মাত্র চার মাসের মাথায় শাস্তিমূলকভাবে বরিশালে বদলি করে দেন ওয়াহেদুজ্জামান। এরপর নিজের আজ্ঞাবহ মো. শহীদ উল্লাহ নামে এক কর্মকর্তাকে ইউএনও হিসেবে পদায়ন করিয়ে নেন ওয়াহেদুজ্জামান। পরে এই কর্মকর্তাকে দিয়ে পুরো আড়াই বছর উপজেলা প্রশাসন দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন। সংবর্ধনার নামে এই ইউএনওকে দিয়ে বিভিন্ন স্কুল থেকে চাঁদা তুলে অনুষ্ঠান করা ছিল তার মূল কাজ। মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের সঙ্গে জড়িয়ে নানা বিতর্কের পর শহীদ উল্লাহ বদলি হলে মনোহরদীর ইউএনও হিসেবে নিয়োগ পান তারিক হাসান নামের ২৯তম ব্যাচের এক কর্মকর্তা। তারিক হাসান নিয়োগ পাওয়ার পর পরই তার কাছে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান নানা অন্যায় আবদার করতে থাকেন। এই কর্মকর্তা শুরুর দিকে কয়েক দিন ওয়াহেদুজ্জামানের ডাকে সাড়া দিয়ে তার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতেন। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর আর তার ডাকে খুব বেশি সাড়া দিতেন না। ফলে এই কর্মকর্তার ওপর ক্ষিপ্ত হন ওয়াহেদুজ্জামান। এক পর্যায়ে পাঁচ মাসের মাথায় এই কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। তবে শুধু বদলি করেই ক্ষান্ত হননি। তারিক হাসান যে মন্ত্রণালয়ে বদলি হন সেখানে যাতে তাকে গ্রহণ করা না হয়, সেজন্য তদবির করেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান। একইভাবে গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এক আত্মীয়ের পক্ষে কাজ না করায় পার্শ্ববর্তী শিবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে স্ট্যান্ড রিলিজ করিয়েছেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান।
এসব বিষয়ে নরসিংদীর বর্তমান জেলা প্রশানক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন শুরুতে কিছুটা বিরক্ত থাকলেও পরে তিনিও ম্যানেজ হয়ে যান বলে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। ফারহানা কাউনাইনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সাবেক এক আমলা, যিনি বর্তমানে অন্য একটি জেলার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ; তিনি মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের বন্ধু। এ বন্ধুকে দিয়ে ডিসিকে তিনি ম্যানেজ করে ফেলেন বলেও এলাকাবাসীর ভাষ্য।
অবসর নেওয়ার পরও মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানকে পুলিশ প্রটোকল দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে মনোহরদী থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ওইভাবে তো উনাকে প্রটোকল দেওয়া হয় না। মাঝেমধ্যে পুলিশের প্যাট্রল টিম যেতে পারে। ’
মাছ পেলে খুশি তিনি : গ্রামের বাড়িতে কখনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, আবার কখনো স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ অনেকেই আসেন বিশাল আকারের মাছ নিয়ে। পাশের জেলা কিশোরগঞ্জ ও ভৈরব থেকে এসব মাছ কিনে এনে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানকে দেন তারা। বিনিময়ে তিনি তাদের হয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে নানা তদবিরে ভূমিকা রাখেন। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রয়েছে নিজস্ব বলয় : আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে সবুজ সংকেত পেয়েছেন, তাই নির্বাচনে অংশ নিতে মাঠ গোছানোর কাজে হাত দিয়েছেন এমন আওয়াজ প্রায়ই দেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান। আর প্রচণ্ড ক্ষমতাধর হওয়ায় আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধাভোগী লোক এসে ভিড় জমায় তার পাশে। দলের কোনো পদ-পদবিধারী না হলেও উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি আশীর্বাদ দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। ওয়াহেদুজ্জামান তার কিছু স্বজন ও সুবিধাবাদী লোকের মাধ্যমে হাতিরদিয়া তথা মনোহরদীকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ওয়াহেদুজ্জামানের দুই ভাই খালেকুজ্জামান মোল্লা খোকা ও তারেকুজ্জামান মোল্লা এবং বন্ধু মোয়াজ্জেম হোসেন বকুল, চাচাত ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা রফিকুল ইসলাম ফারুক আলী শাহ, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মুকসেদুল আলম নীলু, হাতিরদিয়া বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আহসান কবির জুয়েল। তারা বাজারের ইজারা থেকে শুরু করে নিরীহ মানুষের জমি দখল, চাঁদাবাজি, চাকরি, তদবির বাণিজ্য ও নিরীহ মানুষকে হয়রানিসহ যত রকম অবৈধ কাজ আছে তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরকারি জমি নিজের কব্জায় : নরসিংদী জেলার কয়েকটি বাজারের মধ্যে হাতিরদিয়া অন্যতম। বাজার মসজিদের পার্শ্ববর্তী দেড় শতাংশ সরকারি জমি বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ১৯৯৬ সালে ব্যবসায়ীদের বরাদ্দ বাতিল করে ওই জায়গায় গড়ে তোলা হয় গণশৌচাগার। দীর্ঘদিন পর ২০১২ সালে গণশৌচাগারটি ভেঙে কিছুটা দূরে নদীর পাড়ে নতুন গণশৌচাগার নির্মাণ হয়। এদিকে দীর্ঘদিন ব্যবসা করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা গণশৌচাগার নির্মাণ এবং বাজার কমিটি মার্কেট নির্মাণের জন্য জমিটি বরাদ্দের আবেদন করে। জমিটির অবস্থান বাজারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হওয়ায় এতে দৃষ্টি পড়ে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের পরিবারের। জেলা প্রশাসন বাজার কমিটির আবেদন উপেক্ষা করে আকরাম হোসেন, শাহজাহান আফ্রাদ ও মাহফুজুর রহমান নামে তিন ব্যক্তিকে জমিটি বরাদ্দ দেয়। এদের মধ্যে আকরাম হোসেন হচ্ছেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের বাড়ির কেয়ারটেকার। আর আকরাম হোসেনের নিকটাত্মীয় শাহজাহান আফ্রাদ। বরাদ্দ পাওয়া মাহফুজুর রহমান হচ্ছেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের ছোট ভাই মোল্লা তারেকুজ্জামান তারেকের বন্ধু। পরে তারেক মোল্লা সে জমি লিখে নেন। সচিবের টয়লেটের জমি দখলের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে এলে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। তারপরও বাতিল হয়নি লিজ। বর্তমানে সেখানে একটি আধাপাকা মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে।
সেই মার্কেটের দোকানি হুমায়ূন কবির বলেন, ‘এই মার্কেট সচিব সাহেবের। ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে মাসিক ২ হাজার টাকা চুক্তিতে ৪ বছর ধরে ব্যবসা করছি। এই দোকানের ভাড়া নেন সচিব সাহেবের প্রতিনিধি বাচ্চু। অপর দুটি দোকানের ভাড়া নেন তার ভাই তারেকুজ্জামান মোল্লা ও বাড়ির কেয়ারটেকার আকরাম হোসেন। ’
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গড়ে উঠেছে হাতিরদিয়া বাজার। নদীপথে বাজারের মালামাল ও জনসাধারণ যাতায়াতের জন্য তৈরি করা হয়েছিল পাকা ঘাট। হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন উৎসব-পার্বণে এই ঘাট ব্যবহার করায় এটা ঋষিঘাট নামে পরিচিত। গত কয়েক বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে বাজারের ময়লা ফেলে ঘাটটি ব্যবহারের অনুপযোগী করা হয়েছে। সম্প্রতি সরকারি এই ১২ শতাংশ জমি মো. ফিরোজ ও নিতাই চন্দ্র নামে দুই ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা দুজনই খালেকুজ্জামান মোল্লা খোকার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তিনি প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে বেনামে তাদের নামে জমিটি বরাদ্দ নিয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। একইভাবে হাতিরদিয়া বাজার পরিচালনা কমিটির কার্যালয়টিও বেনামে লিজ করিয়েছেন তিনি। সেটিও দখলের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে বলে বাজারের ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন।
এদিকে বাজারের সদর রোডে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন ব্যবসা করে জমির মালিক বনে গেছেন মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের চাচাত ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা রফিকুল ইসলাম ফারুক আলী শাহ। জমির প্রকৃত মালিকরা বেদখল জমি ফিরে পেতে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জমির মালিক জহিরুল ইসলাম ভূঞা এহতেশাম বলেন, ‘জমিটি আমাদের পৈতৃক। বাবার কাছ থেকে দোকানটি ভাড়া নিয়েছিল আলী শাহ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রেকর্ডের ভুলের সুযোগ নিয়ে সে আর ভাড়া না দিয়ে জমিটি দখল করে নেয়। ইতিমধ্যে আমরা আদালত থেকে রেকর্ড সংশোধনী রায় পেয়েছি। তারপরও সে মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামানের পরিবারের সদস্য হওয়ায় তার প্রভাব খাটিয়ে আমাদের পৈতৃক জমিটি দখল করে রেখেছে। আমরা জমিটি ফেরত চাই। ’
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান বলেছেন, ‘আমি জামুকা থেকে সনদ বাতিলের শুনানির বিষয়ে কোনো চিঠি এখনো হাতে পাইনি। এ ছাড়া অবসরের পরও প্রটোকল নেওয়া এবং প্রশাসনে প্রভাব বিস্তারের মতো কোনো কাজ আমি করি না। ’