ফাইনালে জিনেদিন জিদানের জাদু আর রোনালদোর রহস্যময় অসুস্থতা, ফুটবলের কাছ থেকে অবশেষে ফ্রান্সের কিছু পাওয়া, আনকোরা ক্রোয়েশিয়ার উত্থান, আর্জেন্টিনার অভিজ্ঞ রক্ষণকে বোকা বানিয়ে মাইকেল ওয়েনের গোল, বেকহ্যামের লাল কার্ড কিংবা বার্গক্যাম্পের পায়ের মায়াবী কারুকাজে আর্জেন্টিনার বিদায়- ১৯৯৮ বিশ্বকাপকে ফুটবলপ্রেমীরা মনে রেখেছে অনেক কারণেই।
সে তুলনায় এসে বাহারমাস্তের নামটা সেভাবে আলোচনায় আসে না। ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের রেফারি অবশ্য এমন কেউ নন, যাকে সবাই এক নামে চিনবে। ’৯৮ বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র রেফারি হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন। গর্বের বিষয় নিশ্চিতভাবে, রেফারিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বিশ্বকাপে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, এ কি চাট্টিখানি কথা?
গ্রুপ পর্বে দুটো ম্যাচের দায়িত্ব দেয়া হলো বাহারমাস্তকে- স্পেন বনাম নাইজেরিয়া, ব্রাজিল বনাম নরওয়ে। ব্রাজিল আর নরওয়ে ছিল গ্রুপ ‘এ’ তে, বাকি দুই দল মরক্কো আর স্কটল্যান্ড। গ্রুপপর্বের শেষ রাউন্ডে মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল-নরওয়ে আর মরক্কো-স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ড আর মরক্কোর সঙ্গে জিতে ব্রাজিল ততদিনে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে, শেষ ম্যাচের ফল নিয়ে তাই ব্রাজিলের মাথাব্যথা ছিল না। মরক্কো আর নরওয়ের অবশ্য সে বিলাসিতা করার সুযোগ হয়নি। শেষ রাউন্ডে স্কটল্যান্ডকে ৩-০ গোলে হারিয়ে মোট পয়েন্ট চার পাওয়া মরক্কো প্রার্থনায় বসে গিয়েছিল, ব্রাজিলের বিপক্ষে কোনোভাবেই যেন নরওয়ে না জেতে। কারণ জিতলেই মরক্কোকে টপকে পাঁচ পয়েন্ট হয়ে যাবে নরওয়ের, দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার আশা পূরণ হবে না আফ্রিকান দেশটার। তবে উত্তর ইউরোপের নর্ডিক দেশটা ব্রাজিলকে হারাতে পারবে, এটা হয়তো পাঁড় নরওয়েভক্তেরও কল্পনায় ছিল না।
তো যাই হোক, ম্যাচ শুরু হলো। ৭৮ মিনিট পর্যন্ত গোলহীন থাকা ম্যাচে প্রাণ আনলেন বেবেতো, দুর্দান্ত হেডে গোল করে এগিয়ে দিলেন ব্রাজিলকে। আড়মোড়া ভাঙল নরওয়ের। চেলসির স্ট্রাইকার তোরে আন্দ্রে ফ্লো ডান পায়ের কোনাকুনি এক শটে সমতায় ফেরালেন নরওয়েকে। মরক্কো আর নরওয়ের প্রত্যেকটা মানুষ ততক্ষণে প্রার্থনায়, নরওয়ের চাওয়া আর এক গোল, মরক্কোর ঠিক উল্টোটা।
কিন্তু মরক্কানদের প্রার্থনা বিফলে গেল। ৮৮ মিনিটে তোরে আন্দ্রে ফ্লো-কে বক্সে পড়ে যেতে দেখে পেনাল্টির বাঁশি বাজালেন বাহারমাস্ত। সেখান থেকে গোল করে দেশবাসীকে উচ্ছ্বাসে ভাসালেন কিয়েতিল রেকদাল। মরক্কো নয়, দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের পিছু পিছু উঠল নরওয়েই।
এরপর শুরু মূল কাহিনির। মাঠে থাকা ১৬ ক্যামেরার কোনোটাই ধরতে পারল না, ঠিক কী দেখে নরওয়েকে পেনাল্টি দিয়েছেন বাহারমাস্ত। প্রত্যেকটা ক্যামেরায় দেখা গেল, ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার জুনিয়র বাইয়ানো আর তোরে আন্দ্রে ফ্লো বাম দিক থেকে উড়ে আসা ক্রসটার নাগাল পাওয়ার জন্য একসঙ্গে লাফ দেন, এরপর বাইয়ানোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যান ফ্লো। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে দুই হাত প্রসারিত করেন বাইয়ানো, যাতে সবাই মনে করে তার কোনো দোষ নেই, নিছক ধাক্কাই লেগেছে দুজনের মধ্যে।
ব্যস, শুরু হলো বাহারমাস্তের মুণ্ডুপাত। ফ্রান্স, মরক্কো, ব্রাজিল, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বাহারমাস্তকে দোষী করে একের পর এক খবর ছাপতে লাগল। ঠগ, জোচ্চর, অকর্মণ্য, শত্রু- কিছুই শোনা বাকি থাকল না বাহারমাস্তের। এদিকে বাহারমাস্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে যে, বক্সের মধ্যে জুনিয়র বাইয়ানো তোরে আন্দ্রে ফ্লোর জার্সি ধরে টেনেছিলেন! যার একটাই নিয়তি- পেনাল্টি।
দুঃস্বপ্নের মতো দেড় দিন কাটানোর পর অবশেষে বাহারমাস্তের স্ত্রীর চোখ পড়ল এক সুইডিশ পত্রিকার খবরে, যেখানে সম্পূর্ণ অন্য এক কোণ থেকে তোলা ছবি দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে পেনাল্টির সিদ্ধান্তটা সঠিকই ছিল, বাহারমাস্ত নির্দোষ!
ব্যস, এবার শুরু হলো ক্ষমা চাওয়ার বন্যা। গত ৩৬ ঘণ্টায় যারা যারা বাহারমাস্তকে গালি দিচ্ছিলেন সবাই একবাক্যে মেনে নিলেন, বাহারমাস্তই সঠিক! এমনকি এই সিদ্ধান্তটাকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা রেফারিং সিদ্ধান্ত হিসেবে মানা হয় এখন।
বাহারমাস্তের নিজের বক্তব্য কী ছিল এই ব্যাপারে?
‘আমার কাছে, আমার ঈশ্বরের কাছে, এটা অবশ্যই পেনাল্টি। আমার সামনে এই ঘটনা আরও ১০০ বার ঘটলে আমি ১০০ বারই পেনাল্টি দিতাম। কারণ আমি তখন এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম যেখানে বিশ্বের অন্য কোনো ক্যামেরাই ছিল না। আমি দেখেছি কীভাবে জুনিয়র বাইয়ানো তোরে আন্দ্রে ফ্লোর জার্সি টেনে তাকে ফেলে দিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, ঘটনার পর সে নিজে কিন্তু এসে একবারও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেনি, তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থল থেকে সরে দূরে চলে গিয়েছিল। ওর সতীর্থরাই আমার সঙ্গে ঝগড়া করছিল।’
‘দ্য ব্লিচ বয়েজ’
আগেরবার ম্যারাডোনাহীন আর্জেন্টিনাকে থামিয়ে কোয়ার্টারে যাওয়া রোমানিয়াকে নিয়ে ’৯৮-তেও ছিল ভালো কিছুর প্রত্যাশা। গ্রুপপর্বে কলম্বিয়া ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শেষ ম্যাচ খেলার আগেই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে দেশটা সে পথেই এগোচ্ছিল। তিউনিসিয়ার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে ফুরফুরে মেজাজে নামা ঘিওর্ঘি হাজি, ড্যান পেত্রেস্কুরা সবাইকে চমকে দিলেন সম্পূর্ণ ‘অফুটবলীয়’ এক কারণে। দলের সবাই সেদিন চুল ব্লিচ করে ব্লন্ড হয়ে নামেন, দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, একগাদা ব্রয়লার মুরগিছানা মাঠে নেমেছে বুঝি! রোমানিয়ান খেলোয়াড়দের এই কীর্তি দেখে তাদের নামই হয়ে গিয়েছিল- ‘দ্য ব্লিচ বয়েজ!’