পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার জন্য আপনার কাছে জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করুন। আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন। আমাকে মুক্তি দিন অত্যাচারী সম্প্রদায় থেকে।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ১১)
আসিয়া বিনতে মুজাহিম ছিলেন প্রাচীন মিসরের ফেরাউনের (দ্বিতীয় রামেসিস) স্ত্রী। আসিয়া ছিলেন ঈমানদার, এক আল্লাহ বিশ্বাসী। ছিলেন মানুষের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। তার স্বামী ফেরাউন নিজেকে স্রষ্টা বলে দাবি করত। সে ছিল অত্যাচারী ও বদমেজাজি বাদশাহ। অহংকার, দম্ভ ও অহমিকায় পরিপূর্ণ ছিল তার মসনদ।
সে সময় পৃথিবীতে বনি ইসরায়েলে নবি হয়ে আসেন মুসা (আ.)। মুসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরায়েলের লোক। ফেরাউন স্বপ্নের ব্যাখ্যায় জানতে পেরেছিলেন, বনি ইসরায়েলের পুত্রসন্তান দ্বারা তার মসনদ ধ্বংস হবে। পরে সে বনি ইসরায়েলে জন্ম নেওয়া পুত্রসন্তানদের হত্যার আদেশ জারি করেছিলেন। এ রকম পরিস্থিতিতে মুসা (আ.)-এর জন্ম হয়। আল্লাহ মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। আল্লাহর আদেশে শিশু মুসার মা তাকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কাঠের সিন্দুকে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। এই সিন্দুক ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার হাতে পড়ে। শিশু মুসার অপূর্ব সুন্দর চেহারা আসিয়ার মনে দাগ কাটে। তার প্রতি মায়া জন্মায়।
মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রবলভাবে জেগে ওঠে আসিয়ার মনে। তিনি তাকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। পুত্রসন্তান দেখে ফেরাউন চটে যায়। কিন্তু স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের কাছে সে হেরে যায়। আসিয়ার কাছে রাজকীয় সুখানন্দে মুসা লালিত-পালিত হতে থাকেন, বড় হতে থাকেন।
আসিয়া লাভ করেন মুসা (আ.)-এর পালকমাতা হওয়ার গৌরব। কোরআনে এসেছে, ‘ফেরাউনের স্ত্রী বলল, এ শিশু আমার ও তোমার চোখ শীতলকারী। তাকে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। অথচ তারা উপলব্ধি করতে পারেনি।’ (সুরা কাসাস, আয়াত: ৯)
ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলেন আসিয়া। ছিলেন ভদ্র, শালীন, দয়ালু ও জ্ঞানী। ফেরাউনের স্ত্রী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ফেরাউনের দুশ্চরিত্রের কোনো স্বভাব তাকে গ্রাস করতে পারেনি। অত্যাচারীর ঘরে থেকেও তিনি ছিলেন মানবতাবাদী ও মানুষের হিতৈষী। এসব বিশেষ গুণই তাকে এক আল্লাহ বিশ্বাসী হতে সাহায্য করেছে। তিনি মুসা (আ.)-এর ধর্মগ্রহণ করেন। এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনেন।
এদিকে খোদা দাবিদার ফেরাউন ছিলেন মুসা (আ.)-এর পরম শত্রু। নিজের স্ত্রী অন্যের উপাসনা করে—এমন খবর জানতে পেরে ফেরাউন স্ত্রীকে বোঝাতে থাকেন। নিজের বিশাল সাম্রাজ্য ও প্রজাদের কথা বলেন। কিন্তু আসিয়া সত্য ধর্মের ওপর পাহাড়ের মতো অবিচল, অটল। ফেরাউন দেখল, কাজ হয় না। স্ত্রী ফিরে আসছে না তার দলে। সে বিশেষ লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে আসিয়াকে হত্যার আদেশ দেয়।
একদিন ফেরাউনের সৈন্য-সামন্তরা আসিয়ার হাত-পা বেঁধে উত্তপ্ত সূর্যের নিচে ফেলে রাখে। তার দেহ রক্তাক্ত হয়। শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়। তবু তিনি মুখে জারি রাখেন আল্লাহর নাম। অন্তরে জাগিয়ে রাখেন প্রভুপ্রেমের স্বাদ। জীবনের বিনিময়ে ঈমানকে রক্ষা করেন। দুনিয়ার রাজপ্রাসাদের বিনিময়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন জান্নাতে আল্লাহর পাশে একটি ঘর। তার প্রার্থনার কথা কোরআনে বাঙময় হয়েছে এভাবে—‘হে আমার প্রতিপালক, আমার জন্য আপনার কাছে জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করুন। আমাকে ফেরাউন ও তার দুষ্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন। আমাকে মুক্তি দিন অত্যাচারী সম্প্রদায় থেকে।’ (সুরা তাহরিম, আয়াত: ১১)
আল্লাহ আসিয়াকে সম্মানিত করেছেন। তাঁর প্রতি খুশি হয়েছেন। কোরআনে তার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। পরবর্তী জাতির জন্য তার জীবনে শিক্ষা রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষদের মধ্যে অনেকে পুণ্য অর্জন করেছেন। তবে নারীদের মধ্যে পুণ্য অর্জন করেছেন শুধু মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া…।’ (বুখারি, হাদিস: ৩৪১১)
লেখক : রায়হান রাশেদ, আলেম ও সাংবাদিক